• blogger
  • facebook
  • linkedin
  • twitter
  • youtube

রোহিঙ্গা শরণার্থী – মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি!

রোহিঙ্গা – পৃথিবীর অত্যাচারিত এবং অতি নিপীড়িত একটি জাতিসত্তার নাম। রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিধন কোন নতুন বিষয় নয়, রোহিঙ্গাদের উপর বর্মী সেনাদের পরিকল্পিত আক্রমণ সেই ১৯৬০-এর দশক থেকেই শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে এক নতুন মাত্রায় আক্রমণের ফলে প্রায় সাত থেকে আট লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে রাখাইনে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে; যা আধুনিক যুগের সংঘঠিত সংখ্যালঘু আক্রমণ এবং জাতিগত নিধনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রাণে বাঁচিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে গিয়ে শত শত রোহিঙ্গা শিশু এবং নারী নাফ নদীতে ডুবে মারা গিয়েছেন আর শুধুমাত্র বার্মাতেই প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন – এটা ন্যূনতম তথ্য, এই সংখ্যাটি আরো অধিক হতে পারে। জাতিগতভাবে মুসলিম হওয়াতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শুধুমাত্র যে বর্মী-সেনা কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে তাই নয়, বরং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সমাজের একটি শ্রেণী থেকেও রোহিঙ্গারা গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

রোহিঙ্গাদেরকে বর্তমানে মায়ানমার (১৯৮৯ সালের পূর্বে বার্মা নামে পরিচিত ছিল) নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি না দিলেও তাঁদের ইতিহাস ১৭৯৯ সালে সর্বপ্রথম তুলে ধরেন ফ্রান্সিস বুকানান নামক একজন স্কটিশ শল্যবিদ। উনার তথ্যমতে বার্মাতে তৎকালীন আরাকান সাম্রাজ্যে (বর্তমানের রাখাইন প্রদেশ) “মোহাম্মদীন” নামক মুসলিম গোষ্ঠী বহু আগে থেকেই বসবাস করতো “রোয়িংগা” নামে। ইতিহাসবিদদের মতে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক বার্মা উপনিবেশায়নের ফলে বাংলাদেশ থেকে অনেকে কৃষি-শ্রমিক হিসাবে রাখাইনে দেশান্তরিত হয়, যাঁদেরকে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের অবসান ঘটে এবং বার্মা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ১৯৬২ সালে বার্মাতে সেনা শাসনের শুরু হয় এবং তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার অব্যাহত থাকে। যেমন ১৯৭৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রোহিঙ্গাদেরকে ভোটাধিকার দেয়া হয় নাই। এরপর ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বর্মী সেনাদের বর্বর হামলার কারণে; একই বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা ডায়রিয়া এবং অপুষ্টিতে মারা যায়। ১৯৮২ সালে বার্মায় সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয় এবং রোহিঙ্গারা একটি রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠীতে পরিণত হন।

এরপর ২০১২-১৩ সালে একাধিক বৌদ্ধ এবং মুসলিম জাতিগত সংঘর্ষের কারণে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এদের অনেকেই বার্মার অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে অনেকেই মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যান প্রধানত বৌদ্ধ মতাবলম্বী সন্ত্রাসীদের আক্রমনের কারণে। ঐ বছর শুধুমাত্র প্রকাশিত তথ্য মতে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার এবং নিপীড়নের ভয়ে বার্মা থেকে সমুদ্রপথে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলে যায় এবং এর ফলে কমপক্ষে এক হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে নৌকাডুবি হয়ে মারা যায়। ২০১৩ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ত্রাণ এবং দাতা সংস্থাদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা শুরু করে এবং ২০১৪ সালে “সীমান্তবিহীন ডাক্তার” আন্তর্জাতিক এনজিও-র উপর পরিপূর্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদেরকে সহায়তা করার কারণে বৌদ্ধপন্থী চরমপন্থীরা একাধিক আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা আক্রমণ করে এবং মিয়ানমার সরকার ঐসকল প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। একই বছর এপ্রিল মাসে বর্মী সেনাকতৃক জাতীয় আদমশুমারি করা হলেও সেখানে রোহিঙ্গাদেরকে গণনায় উপেক্ষিত করা হয় এবং প্রায় ৩০০ আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার কর্মীকে মায়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যায় এবং একই সালে বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের উপর দুটি সন্তানের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সময় নির্ধারণ করে দেন এবং সন্তান জন্মদানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেন; এছাড়াও রোহিঙ্গাদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বী কারো সঙ্গে বিবাহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসের জাতীয় নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদেরকে ভোটগ্রহণে অংশগ্রহণ করতে বিরত রাখা হয় এবং এই নির্বাচনে বর্তমান রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী “অং সান সু চি” নির্বাচিত হন। রাখাইনে সাম্প্রতিক আক্রমণের কারণে প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা আসার আগেও বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আরো তিন লক্ষ রোহিঙ্গা ছিলেন। বর্তমানে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ এবং কুতুপালং পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির হিসেবে এখনই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে।

সারাবিশ্বে রোহিঙ্গাদের আনুমানিক সংখ্যা এখন প্রায় ১৬ লক্ষ হয় ধারণা করা হয়, যার মাঝে মিয়ানমার আছে প্রায় ৩ লক্ষ এবং বাংলাদেশে ১০ লক্ষ। এছাড়াও উনারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে – যেমন আনুমানিক দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আছেন সৌদি আরবে, প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা আছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, পাকিস্তান আছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ রোহিঙ্গা, ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আছে ভারতে, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার, মালয়েশিয়াতে আছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক, এবং ইন্দোনেশিয়ায় আছে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইহা বলা সম্ভব যে আরাকান সাম্রাজ্যে ষোড়শ শতাব্দীর আগে থেকেই রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠী বসবাস করত, এরপর ১৮২৪ সাল থেকে বার্মাতে ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে তৎকালীন খাদ্য সংকট মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে কৃষক হিসাবে অনেকেই বার্মাতে দেশান্তরিত হয়। ১৯৮২ সনের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ১৮২৩ সনের পূর্বে কারো পূর্বপুরুষ বার্মাতে স্থায়ীভাবে থাকলেই শুধু বর্তমানে নাগরিকত্ব পেয়ে থাকেন কিন্তু ১৮২৩ সনের পরবর্তী সময়ে যারা বার্মাতে বসবাস শুরু করেছেন তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় না। এই বিশেষ আইনটি ১৯৮২ সনে শুধুমাত্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রহীন করার জন্যই বার্মিজ সরকার গ্রহণ করে; এর ফলে প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন বার্মা অথবা বর্তমানের মিয়ানমার সরকার কখনোই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাথে এক কাতারে নেয়ার পক্ষে নয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এবং মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর পরিকল্পিত নিধন চালানো হচ্ছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে যে প্রায় পঞ্চাশটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া রোহিঙ্গা গ্রামকে বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে মিয়ানমার সেনাদের উপরে যে সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে সেসব তথ্য উপাত্ত ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। শুধু যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাই নয় বরং এর সাথে স্থানীয় সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্থানীয় জনগণ একত্র হয়ে এই গণহত্যায় অংশ গ্রহণ করে; এর প্রমাণ থমসন এন্ড্ রয়টার্স-এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে – যার কারণে তাদের দুই জন সাংবাদিককে মিয়ানমার সরকার জেলে আটক করে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যার শামিল বলে উল্লেখ করেছেন এবং শুধু তাই নয় বিশ্বব্যাপী এই বর্বরতাকে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত এবং বর্বর নিধনের একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমতাবস্থায় হত্যা, ধর্ষণ, শিশু এবং নারী নির্যাতন, গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়া, গুলি করে হত্যা করা, বর্ডারে স্থল মাইন্ পুঁতে রেখে মানুষ হত্যা, আর্মি হেলিকপ্টার থেকে নিরীহ এবং নিরস্ত্র মানুষের হত্যা করা ইত্যাদি থেকে শুরু করে এমন কোন অন্যায় কর্ম নাই যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকার, বৌদ্ধ উগ্রপন্থী গোষ্ঠী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী করে নাই। তাদের এই নিধন থেকে মুক্তি পেতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। অনেকেই সমুদ্র পার হতে গিয়ে ডুবে মারা গিয়েছেন।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে রোহিঙ্গাদের উপরে মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন কোন নতুন বিষয় নয়, বরং তাদের উপর এই অত্যাচার বিগত প্রায় ছয় দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদেরকে হয় মুসলিম সংখ্যালঘু অথবা বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিয়ানমারে এরকম চরম অনিশ্চয়তা এবং মানবাধিকার বিপর্যয় কাটিয়ে রোহিঙ্গারা প্রায়ই দুই সপ্তাহব্যাপি দুর্গম যাত্রাপথে রাখাইন থেকে নাফ নদী এবং ক্ষেত্রবিশেষে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলায় পৌঁছতে হয়। জীবন নিয়ে কোনরকমে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শরণার্থী কিংবা উদ্বাস্তুর মর্যাদা লাভ করে। বাংলাদেশ থেকেও তাদের পক্ষে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকায় রোহিঙ্গারা অনেকটা রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে!

কক্সবাজার বাংলাদেশের একটি বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জেলা – একদিকে সমুদ্র অপরদিকে পাহাড়বেষ্টিত। কক্সবাজার যেরকম অতিমাত্রায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর একটি জেলা, পক্ষান্তরে বর্ষাকালে কক্সবাজার জেলা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। কেননা বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) কক্সবাজারে প্রায় প্রতি বছরই ৪ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এবং এই সময়ে অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যা এবং পাহাড়ধস একটি অতি পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যদিও ইহাকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলাটাই শ্রেয় কেননা কক্সবাজারে আজোবধি যেসকল পাহাড়ধসের প্রমাণ মিলেছে তার সাথে মানবসৃষ্ট পাহাড় কেটে পাহাড়ের উপর এবং পাহাড়ের বিপদজনক ঢালে অপরিকল্পিত উপায় বসত বাড়ি তৈরি করাকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হয়। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন যে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে মূলত পাহাড় কেটে এবং বনভূমি উজাড় করে নিজেদের অস্থায়ী তাবু/ছাউনি/ঘর বা ক্যাম্পগুলা বানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা আসার আগেও কক্সবাজার শহরের অনেক জায়গায় পাহাড় কেটে হোটেল, ঘরবাড়ি এবং লোকালয় বানানোর নজির রয়েছে, যা পরবর্তীতে পাহাড়ধস এবং পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হাতছানি। নতুন করে এভাবে ব্যাপক আকারে বনভূমি ধ্বংস এবং পাহাড় কাটার ফলে আসন্ন বর্ষায় মহাদুর্যোগের আশংকা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাদের সহায়তায় পাহাড় কেটে নতুন ভাবে গড়ে ওঠা কিংবা কুতুপালং ক্যাম্পের বর্ধিতকরণ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে? এই প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাদেরকে কি আরেকটু নিরাপদ সমতলে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়া যেত না?

এই ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা অনেক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শিশুরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ পানিবাহিত এবং অন্যান্য রোগে; অনেকেই মানসিক আঘাতে জর্জরিত আছেন। অতিমাত্রায় ঘিঞ্জি পরিবেশে তাঁদেরকে থাকতে হচ্ছে এবং এর সাথে আছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, পর্যাপ্ত শৌচাগার এবং অন্যান্য দৈনন্দিন সুযোগ-সুবিধার অভাব। যদিও তাঁদের এখন বর্মী সেনা এবং বৌদ্ধধর্মালম্বী চরমপন্থীদের হাতে মৃত্যু ভয় নেই, কিন্তু নতুন করে ভয় আছে পাহাড়ধস, পাহাড়ি ঢল, রোগ ব্যাধি এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সরকার প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেখানে তারা যেখানে তাদেরকে বসবাসের জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে যার ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের একটি ব্যবস্থা হবে কিন্তু এই চরটি চরমভাবে ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হতে পারে; এর ফলে রোহিঙ্গাদের উপরে আরো মানবিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসতে পারে। এ যেন – রোহিঙ্গারা বর্মী সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে একটি দুর্যোগকে পাশ কাটিয়ে গেলেও বাংলাদেশে এসে আগত প্রাকৃতিক এবং অস্থায়ী শিবিরে নানাবিধ সমস্যার কারণে যেন আরেক নতুন দুর্যোগের মুখে পতিত হয়েছে!

গত বছরের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া ছাড়াও মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং মিয়ানমারের হেলিকপ্টার প্রায় আঠারো বার বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে। যা নিশ্চিতভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার শামিল কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বুদ্ধিমত্তার সাথে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা শুধু যে জাতিসংঘ অনুমোদিত নির্দিষ্ট আশ্রয় শিবিরে আছে তাই নয় বরং কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা এবং গ্রামের স্থানীয় জনগণ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন; কিন্তু এই ছয় মাসের ব্যবধানে স্থানীয় জনগণের মাঝে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এবং তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে – “রোহিঙ্গারা কবে ফিরে যাবে”? স্থানীয় অনেকের মতেই রোহিঙ্গাদের আগমন উপলক্ষে কক্সবাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে; যার ফলে স্থানীয় অসন্তুষ্টি দিনে দিনে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক এই নির্যাতনের চিত্র সমগ্র বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক প্রসিদ্ধ নেতা, ধর্মীয় গুরু এবং সমাজকর্মীরা ইতিমধ্যে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং রোহিঙ্গাদেরকে নির্দ্বিধায় মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আহবান করেছেন। মিয়ানমার সরকার নানাবিধ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে এখন রোহিঙ্গাদেরকে ফিরে নেয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তবুও এটি এখনও নিশ্চিত নয় যে তারা এই দশ লক্ষ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিবেন কিনা! সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এবং মিয়ানমার সরকারের মাঝে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেয়ার কথা বলা হয়; কিন্তু রাখাইনের গ্রামগুলো এখনো রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয় এবং তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নাই এরকম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা এই চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সেই সাথে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গারাও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং জীবিকা নির্বাহের সুযোগ-সুবিধা না থাকার ভয় রাখাইনে ফিরে যেতে চাচ্ছেন না। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী চাপ থাকলেও সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় অতি নিকটবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়া এখন অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজারের স্থানীয় জনরোষ বেড়েই চলেছে, এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একটি দরিদ্র এবং অতি ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠির দায়িত্ব একক ভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে প্রতিদিন প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের রুটি-রোজগার এবং জীবন নির্বাহ করানো একটি অতি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া এবং এই সহায়তা আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ আর কত মাস কিংবা আর কত বছর চালিয়ে যেতে পারবেন তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নলিখিত স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে –

স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা সমূহ:

[১] বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দৈনন্দিন খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা যেকোন মূল্যে অব্যাহত রাখতে হবে। ইহা আমাদের মানবিক, এবং রাষ্ট্র ও জাতি হিসাবে একটি সামাজিক দায়িত্ব। এর জন্য পৃথিবীর সকল উন্নত দেশসমূহকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও এবং ত্রাতা সংস্থার মাধ্যমে এই জাতিগত সমস্যা চূড়ান্ত সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সকল সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখতে হবে।

[২] অতিমাত্রায় পাহাড় কাটা এবং বনভূমি বিনাশের কারণে বর্তমানের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ব্যাপক মাত্রায় পাহাড় ধস এবং পাহাড়ি ঢলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ঘরগুলো ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমতাবস্থায় সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অতি জরুরী ভিত্তিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে করে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগেই যেন নির্দিষ্ট দুর্যোগ প্রবণ এলাকা থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে নিরাপদ আশ্রয় স্থানে সরিয়ে নেয়া যেতে পারে।

[৩] শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় – ক্যাম্পে বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দূরদর্শার কারণে বর্ষাকালে নানাবিধ পানিবাহিত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই ব্যাপারেও পূর্বসতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

[৪] শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমবিকাশের দিকেও নজর দিতে হবে; এছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের কে পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং মানবিক বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

[৫] মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাতে এখনো অনেক রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছেন, তাদের জন্যও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে।

[৬] এখনও প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকছেন, এই ব্যাপারেও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।

[৭] ক্যাম্পগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদেরকে বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী, শিশু, বয়স্ক, শারীরিক এবং মানুষিকভাবে অক্ষম এবং অন্যান্য বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত শরণার্থীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নিতে হবে।

[৮] রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নানাবিধ সন্ত্রাসী তৎপরতা, জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, নারী এবং শিশু পাচার, যেকোনো ধরনের অসামাজিক এবং অবৈধ কর্মকান্ড; কিশোর অপরাধ; এবং অন্যান্য সামাজিক, ধর্মীয়, এবং রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মতৎপরতা থেকে সকলকে বিরত রাখার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে সতর্ক ভূমিকায় থাকতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সমূহ:

[৯] রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং সম্মানের সহিত নিজেদের পূর্বপুরুষের গ্রামে ফেরত পাঠানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে জটিল কাজ, কিন্তু জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়া অনেকটা তাদেরকে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার শামিল। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের সহায়তায় এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রের পরামর্শে মিয়ানমারের রাখাইনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং জীবন-জীবিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তার নিমিত্তে পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে যেতে সাহায্য করতে হবে; সেক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে।

[১০] বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা রাখাইনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং জীবিকা নির্বাহের সুযোগ-সুবিধা এবং সকল নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন কিনা এ বিষয়ে নজরদারির জন্য জাতিসংঘের আনুষঙ্গিক বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুরাষ্ট্রের নিরবিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখতে হবে।

[১১] রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে যদি আসলেই কোন অবৈধ বাংলাদেশি থেকে থাকেন তবে তাদেরকে যাচাই বাছাই করার মাধ্যমে আলাদা করতে হবে এবং তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান সাপেক্ষে বাংলাদেশেই জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

[১২] রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর এই বর্বর হামলার কারণে জাতিগত বিদ্বেষ কিংবা প্রতিশোধের মতো কোন ধরনের উগ্র চিন্তা যেন কোন বিশেষ গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে এবং এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে যেন কোন ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইহা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

[১৩] যদি একটি বিশেষ সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ভাষানচরে স্থানান্তরিত করা হয় তবে সেক্ষেত্রে অতি বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে যাতে করে কোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয় এবং তাদেরকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা প্রদান করা যায় এবং তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা যায়; এছাড়াও দুর্যোগের পূর্বেই যেন তাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে আনা যায় এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

[১৪] রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার স্বার্থে জাতিসংঘের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি রোহিঙ্গা পরিবারকে বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন সার্বক্ষণিক স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং দরকার হলে রাখাইনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে।

[১৫] যেহেতু এই সমস্যার অতি শীঘ্রই সমাধান সম্ভব নয়, তাই মধ্যবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদেরকে এই দুর্যোগপূর্ণ পাহাড় থেকে সরিয়ে আরো নিরাপদ কোথাও স্থানান্তর করা যায় কিনা এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপক এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

[১৬] আরো অদূর ভবিষ্যতে এভাবে যারা রোহিঙ্গাদের উপর বর্বরোচিত হামলা এবং আক্রমণ করে হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা, লুণ্ঠন, দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার মতো অপরাধে জড়িত ছিল তাদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করে পর্যাপ্ত সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। এধরনের দৃষ্টান্তমূলক সাজার ফলে আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে আর কেউ জাতিগত নিধন এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো থেকে বিরত থাকবেন।

………………………………………………………….

সারসংক্ষেপে বলা যায় যায় যে রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন একটি জটিল এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফসল। এই ঘটনা কোনো একক ব্যক্তি বা একক প্রক্রিয়ার ফলাফল নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে শত বছরের ইতিহাস, জাতিগত সংঘাত, উপনিবেশের প্রভাব, আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। রোহিঙ্গাদেরকে রাষ্ট্রীয় এবং মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়াটা খুবই জটিল এবং দুরহ একটি প্রক্রিয়া। সমস্যাটি যেমন একদিনে সৃষ্টি হয়নি তেমনি এর সমাধানও একদিনে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া দীর্ঘ ছয় দশকের নির্মম অত্যাচার এবং অবিচারের বিচার যে খুব শীঘ্রই হবে এমনটা আশা করাটাও ঠিক নয়। এমনকি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনের যে অভিযোগ রয়েছে সেটার সুষ্ঠু বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে কবে হবে ঠিক নাই। রোহিঙ্গাদের ওপর মানব সৃষ্ট জাতিগত নিধন যেমন সত্য, তেমনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও উচ্চ। এভাবে নানাবিধ আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচে প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং রোহিঙ্গারা তাদের ওপর সংঘটিত হওয়া পরিকল্পিত অপরাধের বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় পৃথিবীর সকল সচেতন রাষ্ট্র, জাতিসংঘ, সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষকে একত্রিত হয়ে এই সমস্যা সংকটে নিরলস এবং পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্প মেয়াদী উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলা শুধুমাত্র যেরকম বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় তেমনই মিয়ানমারের পক্ষে সম্ভব নয়; এক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক এবং ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একযোগে কাজ করতে হবে!

তথ্য-উপাত্তের উৎস:

I am an Associate Professor at the Institute for Risk and Disaster Reduction (IRDR) at University College London (UCL). My background includes research into the field of disaster risk reduction (DRR), community vulnerability and resilience, GIS and remote sensing, climate change adaptation, conflict and migration, and climate justice. I obtained a PhD in Disaster Risk Reduction from UCL, a joint MSc degree in Geospatial Technologies from Spain, Germany, and Portugal; and a Bachelor of Urban and Regional Planning degree from Bangladesh University of Engineering and Technology (BUET).

Leave a Reply